১৯ এপ্রিল ১৯৭১ সালচাঁ, নওয়াবগঞ্জ অবরুদ্ধ হয় পাকিস্তানি হানাদারদের হাতে, চালায় অগ্নিসংযোগ আর ধ্বংসযজ্ঞ
আপডেটঃ ১:১২ অপরাহ্ণ | এপ্রিল ২৩, ২০২২
নিউজ ডেস্কঃ
রাজশাহী:- ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ মধ্যরাতে নিরস্ত্র বাঙালির ওপর ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর নামে পাকিস্তান সেনাবাহিনী হত্যাকাণ্ড শুরু করে।শুরু হয় বাঙালির মুক্তিযুদ্ধ।ঢাকায় শুরু হওয়া হত্যাযজ্ঞের রেশ রাজশাহী-চাঁপাই নবাবগঞ্জেও এসে পড়ে। তবে, ১৩ এপ্রিল রাজশাহী শহরের পতন হলেও ১৫ এপ্রিল পর্যন্ত রাজশাহী হতে চাঁপাই নবাবগঞ্জ এলাকাটি ছিল সম্পূর্ণ মুক্ত।১৫ এপ্রিল বিকেল ৫টা থেকে পাক বাহিনী চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহরের ওপর বিমান হামলা শুরু করে।কিন্তু পাক বাহিনীকে প্রতিরোধ করার মতো প্রশিক্ষণ কিংবা প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ শহরের সংগ্রাম কমিটির নিকট না থাকায় কমিটি ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়।ফলে পুরো শহর হয়ে যায় সম্পূর্ণ অরক্ষিত।যার ফলে ১৯ এপ্রিল’১৯৭১ তারিখ সোমবার সকালে পাক বাহিনী গুড়ি গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে অতি নির্বিঘ্নেই আতঙ্কে বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ায় জনমানবশুন্য চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহরে প্রবেশ করে।
তাদের সঙ্গে ছিল রাজশাহী, পাবনা, ঈশ্বরদী হতে আসা কিছু বিহারী দুস্কৃতিকারী।শহরে ঢোকার পর তাদের সংগে যোগ দেয় স্থানীয় পাক সমর্থক ব্যক্তিরাও।শহরে তেমন কোনো প্রতিরোধ না থাকায় মুক্তিযুদ্ধের পুরো ৯ মাসই তারা চাঁপাই নবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ, লুন্ঠন, অত্যাচার-নির্যাতন চালায়।
পাক বাহিনী ১৯ এপ্রিল চাঁপাই নবাবগঞ্জ শহরে প্রবেশ করার পর বেলা ৯. ০০ টার দিকে শুরু হয় লুটপাট।খানসেনারা লুটপাট শুরু করলেও তাতে যোগ দেয় তাদের সাথে আগত ও স্থানীয় বিহারীরাও ( দু’একজন বাদে )।লুটপাটের সঙ্গে চলে অগ্নিসংযোগও।রেলওয়ে স্টেশনের সমস্ত দোকানে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়।সি.এন্ড.বি ডাকবাংলোর আশপাশেও আগুন দেয়া হয়।
অন্যদিকে পাক বাহিনীর অরেকটি দল সকাল ৯ টার দিকে আমার প্রতিবেশী রামকৃষ্টপুরের সিরাজ উদ্দীন চৌধুরীর বাড়িতে হানা দেয়।সে সময় তিনি এবং তার সর্বকনিষ্ঠ পুত্র মোঃ নূরুল হুদা বাড়িতেই ছিলেন।আলমারী ভেঙে সম্পদ লুটের বাসনায় হানাদারদের দ্বিতীয় দফা আগমনের শুরুতেই দোতলার সিঁড়িতে কথোপকথনের এক পর্যায়ে শত্রু সেনারা তার মুখের ওপরই গুলি করে।
তিনি অবশ্য তখনই মারা যান নি।দীর্ঘ ১০ দিন মৃত্যুর সঙ্গে লড়ে ২৯ এপ্রিল মারা যান তিনি।খান সেনারা চাঁপাই নবাবগঞ্জ প্রবেশ করেই কেন সিরাজ চৌধুরীকে প্রথম টার্গেট করেছিল, সে সম্পর্কে পরিষ্কার কোনো ধারণা না থাকলেও, স্থানীয় হিসেবে আমি যতটুকু শুনেছি যে, সিরাজ চৌধুরীর সাথে নবাবগঞ্জ থানার সুসম্পর্ক থাকা এবং থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ও,সি) এবং সেকেন্ড অফিসার যেহেতু তাঁর বাড়িতেই ভাড়া থাকতেন।
বিষয়টি স্থানীয় পাকসমর্থক দালালরা পাক হানাদারদের অবহিত করে।কিন্তু তাদের প্রবেশের পূর্বেই থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ও,সি) এবং সেকেন্ড অফিসার সিরাজ চৌধুরীর বাড়ি ছেড়ে চলে যায়। ফলে তাঁরা বেঁচে যান।কিন্তু তাদের ব্যবহৃত কিছু ইউনিফর্ম ও বুটসহ কিছু জিনিষপত্র সিরাজ চৌধুরীর বাড়িতে ছিল, সেগুলো খানসেনারা পেয়ে যায়।
খান সেনাদের আক্রোশের কারণটি বোধহয় সেখানেই ! ২০ এপ্রিল, মঙ্গলবার শত্রুকবলিত চাঁপাই নবাবগঞ্জের ২য় দিনেও খানসেনারা দিনভর লুটপাট, অগ্নিসংযোগ আর ধ্বংসযজ্ঞ চালায়।রাতেও তা বাদ যায়নি।তবে পাকবাহিনী তাদের স্থানীয় দালালদের যোগসাজশে সর্বাপেক্ষা, ভয়াবহ ও লোমহর্ষক হত্যাকান্ডটি চালায় শহরের নামকরা ও প্রতিষ্ঠিত এল. এম. এফ চিকিৎসক ডাঃ মোঃ মোমতাজ হোসেনের বাড়িতে।
ঐদিন বেলা আনুমানিক ১০ টার দিকে পাকবাহিনী কয়েকজন বিহারীসহ তাঁর শহরস্থ ইসলামপুরের বাড়িতে হানা দেয়।শহরের কেন্দ্রস্থল বড় ইন্দারা মোড়ে তাঁর ডাক্তারী চেম্বার ও ঔষধের দোকান ছিল।ঘাতকবাহিনী তাদের ওপর চড়াও হয়ে গুলি করে হত্যা করে ডাঃ মোমতাজ হোসেন ও তার দুই মেয়ে লীনা ও হ্যাপীকে।তারা দু’জনেই কামাল উদ্দীন বালিকা উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্রী ছিল।
বর্তমানে বড় ইন্দারা মোড়স্থ ‘তাজ’ ফার্মেসীর স্বত্বাধিকারী জাফর আহমেদ ওসমানী শিলার হলেন শহীদ ডাঃ মোমতাজ হোসেন এর পুত্র।২১ এপ্রিল, বুধবার ৩য় দিনে মুক্তিযুদ্ধকালীন শত্রু কবলিত চাঁপাই নবাবগঞ্জের সবচেয়ে নৃশংস, লোমহর্ষক ও জঘন্য হত্যাযজ্ঞটি অনুষ্ঠিত হয়।এটি শ্মশানঘাট হত্যাকান্ড নামেই পরিচিত।
এদিন সূর্যোদয়ের পর থেকেই পাক হানাদার বাহিনী ও তাদের এদেশীয় দোসররা চাঁপাই নবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকা থেকে মুক্তিকামী মানুষকে এনে শ্মশানঘাটে জড়ো করতে থাকে।জনশ্রুতি আছে, এই হত্যাকান্ডে প্রায় ৩০০/৪০০ জন মানুষকে তারা হত্যা করে।এখানেই আমার আত্মীয় রেহাইচরের মফিজ কাকা ও তার ভাগনে শহীদ হন।
৩০ এপ্রিল টেলিফোন অপারেটর আব্দুল জলিলকে এক্সচেঞ্জ ভবন থেকে তুলে নিয়ে যায়।পরবর্তীতে তাকে আর খুঁজে পাওয়া যায়নি।সংগ্রাম কমিটির সদস্যদের খাবার পরিবহনে জীপগাড়ী দিয়ে সহায়তার অপরাধে কৃষি ব্যাংকের গাড়ী চালক হাসিমকে গায়ে পেট্রোল ঢেলে পৈশাচিক কায়দায় হত্যা করেছিল।
পরবর্তীতে আমাদের অনেকের পরিচিত রাজাকারদের সহায়তায় এভাবে হত্যা করেছিল নবাবগঞ্জ কলেজের অধ্যাপক মনিমুল হক, উপর রাজারামপুরের এহসান মাস্টার, মসজিদ (লল্যা) পাড়ার এবুল, ফকিরপাড়ার জাহাঙ্গীর, গম্ভীরার নানা খ্যাত কুতুবুল আলমের স্ত্রী ও ৪ টি নিস্পাপ সন্তানসহ অগণিত লোকজনকে।
আমার বাবার আপন চাচাত ভাই কলাবাড়ীতে যুদ্ধরত অবস্থায় গুলিতে আহত হলে গোপনে বাড়ি ফিরে আসলেও অতিরিক্ত রক্ষক্ষরণে তাঁর মৃত্যু হয়।তাঁকে ফকিড়পাড়া গোরস্থানে সমাহিত করা হয়।অবরুদ্ধ চাঁপাই নবাবগঞ্জে এ সময় মেজর শেরওয়ানী, মেজর ইকবাল ও সু্বেদার মেজর চিমা খান কখনো জীপ গাড়িতে চড়ে, আবার কখনো মটর সাইকেলে চড়ে সারা শহর ঘুরে বেড়াত।
সেসময় চিমা খান ছিল চাঁপাই নবাবগঞ্জের ত্রাস।শহরের পাঠানপাড়ার নির্দিষ্ট কয়েকটি বাড়িতে সে নিয়মিত যাতায়াত করতো।সেসব বাড়িতে কয়েকটি মেয়ের ওপর সে নিয়মিত পাশবিক অত্যাচার করতো বলে তখন শহরে জোর গুজব ছড়িয়েছিল।এভাবেই মুক্তিযুদ্ধকালীন দীর্ঘ ৯ মাসই সারা চাঁপাই নবাবগঞ্জের বিভিন্ন স্থানে পাক হানাদার বাহিনীর ধ্বংশযজ্ঞ চলতে থাকে।
চলতে থাকে হত্যা, বাড়ি-ঘর, দোকানপাটে লুটপাট, ধর্ষণ, অত্যাচার, নির্যাতন, অগ্নিসংযোগ।হানাদার বাহিনী প্রথমে ঘাঁটি গড়ে শহরের উপকণ্ঠ কল্যাণপুরের ই.পি.আর ক্যাম্পে।পরে শহরের বি.ডি (শহীদ সাটু ) হল, সি. এন্ড বি ডাক বাংলো, নবাবগঞ্জ কলেজ, নিউমার্কেট, কোর্ট সংলগ্ন পুলিশ ব্যারাক।
অন্যদিকে শহরের বাইরে শিবগঞ্জের তৎকালীন সি.ও (বর্তমান উপজেলা পরিষদ চত্বর ), রহনপুরের এ.বি উচ্চ বিদ্যালয়।মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে চাঁপাই নবাবগঞ্জের অধিকাংশ অঞ্চলই পাক হানাদারমুক্ত হয় ১৪ ডিসেম্বর।কিন্তু ততোদিনে এজন্য চরম মূল্য দিতে হয়।হারাতে হয় অকুতোভয় বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দীন জাহাঙ্গীরকে।
শহীদ হন ৫৮ (মতান্তরে ৬০ অথবা ৬৪) জন বীর মুক্তিযোদ্ধা।মুক্তিযুদ্ধের শেষ পর্যায়ে ১৩ ডিসেম্বরের রাতটি পাক বাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর মধ্যে প্রচন্ড গোলাগুলির মধ্যে দিয়ে শেষ হয়।১৪ ডিসেম্বর সকাল ৭.৩০-৮.০০ টার দিকে ক্যাপ্টেন জাহাঙ্গীর মুক্তিযোদ্ধাদের একটি দল নিয়ে টিকরামপুর থেকে রেহাইচর চৌরাস্তার মোড়ে একটি বটগাছের কাছে এসে পৌঁছলে আকস্মিকভাবে গুলিবিদ্ধ হন।
তাঁর মরদের ডাঃ মো মহসিন ও ডাঃ মোঃ রবু ভাতৃদ্বয়ের বাড়ির গলির ওপর পড়ে ছিল।তাঁর সঙ্গে আটরশিয়ার মোঃ মোজম্মেল হক শহীদ হন।দু’পক্ষের প্রচন্ড গোলাগুলির মধ্যে দিয়ে ১৪ ডিসেম্বরের রাত্রিটিও শেষ হয়।১৫ ডিসেম্বর সকাল হতে যুদ্ধের তীব্রতা আরও বৃদ্ধি পায়।মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী যৌথভাবে এই যুদ্ধে অংশ নেয়।
মুক্তিবাহিনী একটু একটু করে শহরের মধ্যে প্রবেশ করতে থাকে।পাকবাহিনীও অবস্থা বেগতিক দেখে নিজেদেরকে গুটিয়ে নিতে থাকে।এক পর্যায়ে তারা রাজশাহীর দিকে পালিয়ে যায়।তারা পালিয়ে যাবার পরও মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর প্রচন্ড গোলাগুলির মধ্যে দিয়ে ১৫ ডিসেম্বরের রাত্রিটিও শেষ হয়।পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয় চাঁপাই নবাবগঞ্জ।
১৬ ডিসেম্বর।মুক্তিবাহিনী এদিন বীরদর্পে চাঁপাই নবাবগঞ্জে প্রবেশ করে।চাঁপাই নবাবগঞ্জবাসী আনন্দ উল্লাসের সঙ্গে তাঁদের বরণ করে।উপস্থিত জনতার আনন্দ ধ্বনি ও হাজারো করতালির মধ্যে নবাবগঞ্জ থানা চত্বরে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করা হয়।বিকেলে নবাবগঞ্জ কলেজ মাঠে মুক্তিযোদ্ধা-জনতার এক মিলনসভা অনুষ্ঠিত হয়।
IPCS News : Dhaka : আবুল কালাম আজাদ : রাজশাহী।