শীতের রাতে ফুটপাথে বেঁচে থাকার লড়াইয়ে তারা
আপডেটঃ ১২:১৭ অপরাহ্ণ | ডিসেম্বর ০৮, ২০২৫
নিউজ ডেস্কঃ
রাজশাহী:- রাজশাহীর রাতের দৃশ্য দেখতে আলো ঝলমলে হলেও শীতের রাতে ছিন্নমুল মানুষের রাত্রী যাপন ততটাই ভয়ংকর।লাইট পোস্টের রঙ্গীন আলোর ঝলকানি তাদের কেন কাজে লাগেনা।তাদের চায় দিন শেষে শীত নিবারণের জন্য গরম কাপড় আর দুবেলা খাবার।রাজশাহীর শীত খুব দীর্ঘ না হলেও, যখন শীত নামে অসহায় মানুষের শরীরে তার গভীর কামড়টা কলিজায় লাগে।আনুষ্ঠানিক আবহাওয়ার হিসেবে তাপমাত্রা তাড়াতাড়ী কমে।ফুটপাতে থাকা মানুষদের কাছে সেই হয়ে ওঠে ভয়ানক অসহনীয়।সাজানো গোছানো ব্যস্ত নগর জীবনের ভিড়ে তাদের অস্তিত্ব যেন কারো চোখেই পড়ে না।কিন্তু রাত গভীর হলে, রেলস্টশন চত্বর-বাস টার্মিনাল এলাকা,নগরীর বিভিন্ন ফুটপাত,বাজারের দোকানের শাটার নামলে, উন্মোচিত হয় এক ভিন্ন রাজশাহীর চিত্র।যেখানে ঠান্ডা হাওয়া আর অনিশ্চয়তা মানুষের জীবনকেই হুমকি দেয়।
শিরোইল রেলওয়ে স্কুল ঘেঁষা ফুটপাতে সজিব (৫০) নামের একজন পুরোনো কম্বলের নীচে পাটের বস্তার উপর চিংড়ি মাছের মত বাঁকিয়ে শুয়ে আছেন।কম্বলের মাঝখান দিয়ে বেরিয়ে থাকা হাত দুটো দেখে বোঝা যায়, তার শরীরের প্রতিরোধ ক্ষমতা আর ঠান্ডার শক্তির মধ্যে চলছে এক অসম লড়াই।তিনি বললেন, দিনে যা পাই, রাতে তা দিয়েই চলতে হয়।শীতে সমস্যা আরেকটু বেশি।
কম্বল কিনতে গেলে ৪০০–৫০০ টাকা লাগে, টাকা কোথা থেকে পাব ? নগরীর সাহেববাজারের পথশিশু রিমন (১০) বলে, আমি রাতে কোন না কোন দোকানের সামনে ঘুমাই।রাতে দোকান বন্ধ হলে তার সামনে শুয়ে পড়ি।গরমে মশার কামড় লাগলেই ভালো লাগে।শীতের সময় খুব কস্ট হয়।অনেকে ব্যবহারের অযোগ্য ছেঁড়াফাটা ময়লা কাপড় দেয়।তখন হয়ত আমাদের মত হত-ভাগাদের ভাগে পড়ে।
শিশুটি আরো বলে,গভীর রাতে যখন সবাই ঘুমায়, তখন আমার ভয় লাগে না জানি ঠান্ডার মরে যাবো।তারপরও ঘুমাই, কী করবো? সকালে কাজ করতে হয়—বাজারে ব্যাগ টানি।শীতের রাতে মনে হয় আমাদের কেউ দেখে না।শীত মানে না কম দামী পাতলা কম্বলে, তাতেই উষ্ণতার খোঁজে ছিন্নমূলরা।শহরের বিভিন্ন মোড়ে শীতের সঙ্গে লড়াই করে এমন মানুষের গল্প বাস্তবে অনেক আছে, আর আছে নিঃশব্দ চোখের পানি।
রাজশাহী রেলস্টেশনে, ঢাকা বাস টার্মীনাল,বিভিন্ন মার্কেটের দরজা,শহরের ফুটপাত প্রতিটা জায়গায় শীতের রাতে মানুষ নিজেদের গুটিয়ে নেয় ছোট্ট এক আশ্রয়ে।যাদের মাথার ওপর ছাদ নেই, তাদের রাত্রি যাপন অনিশ্চয়তা আর ভয় নিয়ে আসে।একদল বৃদ্ধ মানুষ আছে, যারা কখনো নিজের পরিবার হারিয়েছে, কখনো পরিবারই তাদের হারিয়ে ফেলেছে, সময় ও দূরত্ব তাদের হিসাবের বাইরে।
রাজশাহী রেলস্টেশন চত্বরে খোলা আকাশের নীচে ঘুমিয়ে থাকা আয়ুব আলী (৬০), মনিরা বেওয়া (৫০),আসমা বেওয়া (৬০) বলেন, তিন বছর ধরে এখানে আছি।আগে খাবার হেটেলে কাজ করতাম।শরীরটা খারাপ হবার পর আর কাজ পায়না,তাই দিনে ভিক্ষা করি আর রাতে ঠান্ডায় এখানে ঘু্মায়।শীতে ঘুম আসে না, অসুস্থ শরির- জ্বর মারণ হয়না।
পাশে জরিনা বেগম (৫৯)পুরোনো একটা পাতলা চাদর গায়ে মুড়ে দিয়ে শুয়ে।কিন্তু শীত তো আর চাদরে যায়না,তার শ্বাস-প্রশ্বাসের মাঝে মাঝেই যেন জমে থাকা বরফের স্পর্শ লেগে থাকে।আবহাওয়া দপ্তর বলছে এবার শীতে কাঁপুনি ধরাতে পারে ৮ শৈত্যপ্রবাহ।শিশুদের কষ্টটাও কম নয়।শীতে ঠান্ডাজনিত অসুখ দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে।অনেকেই অসুস্থ হলেও ডাক্তার দেখানোর সামর্থ্য নেই।
ফুটপাথের মানুষদের জন্য পর্যাপ্ত শীতবস্ত্র নেই, নিরাপদ জায়গা নেই, এমনকি ছোটখাটো ওষুধের ব্যবস্থাও পথশিশুদের বা ফুটপাতে রাত্রী যাপন কারীদের জন্য নাই।ফলাফল অনেকেই এরা জ্বর, কাশি, নিউমোনিয়ার ঝুঁকিতে থাকে প্রতি মুহূর্তে।রেশম কারখানা সংলগ্ন কাপর পট্রিতে মাচার নীচে কোলের শিশুকে বুকে আগলে ধরে শুয়ে থাকা একজন মা বলেন, আমার বাচ্চাটা দুই দিন ধরে ঠান্ডায়, শীত-শীত করছে।
গায়ে জ্বর এসেছে।কিন্তু ওষুধ কিনবো কীভাবে? খাবারের টাকাই ঠিকমতো হয় না।রাজশাহীর রাতের দৃশ্য দেখতে আলো ঝলমলে হলেও শীতের রাতে ছিন্নমুল মানুষের রাত্রী যাপন ততটাই ভয়ংকর।লাইট পোস্টের রঙ্গীন আলোর ঝলকানি তাদের কেন কাজে লাগেনা।তাদের চায় দিন শেষে শীত নিবারণের জন্য গরম কাপড় আর দুবেলা খাবার।
তাদের রাতগুলো অন্ধকার, শীতল, আর অনিশ্চয়তায় ভরা তবু তারা বাঁচে এবং বেঁচে থাকার এই সংগ্রামটুকু যেন আমাদের সকলকে একটু থামিয়ে ভাবায়, এই শহর কি সত্যিই সব মানুষকে সমানভাবে ধরে রাখতে পারে?
IPCS News : Dhaka : আবুল কালাম আজাদ : রাজশাহী।

