বৃহস্পতিবার ১৬ই অক্টোবর, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ ৩১শে আশ্বিন, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সংবাদ শিরোনামঃ

পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব

আপডেটঃ ১২:৩৪ অপরাহ্ণ | আগস্ট ২৮, ২০২৫

নিউজ ডেস্কঃ

আগামীতে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব বলে আশাবাদি রপ্তানিকারকেরা।তবে সে সুদিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।আগামী দিনগুলোয় পাট খাতের রফতানি বাড়ানোর জন্য পাটপণ্যের বহুধারণ নিশ্চিত করতে হবে।রফতানির গন্তব্য সম্প্রসারিত করতে হবে।ভারতের বিভিন্ন শুল্ক ও অশুল্ক বাধার বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার আয়োজন করতে হবে।একই সঙ্গে বিকল্প বাজার খোঁজার উদ্যোগ নিতে হবে।অভ্যন্তরীণভাবে পাটপণ্যের ওপর বিভিন্ন কর রহিত করতে হবে।পাট শিল্পের আধুনিকায়ন নিশ্চিত করতে হবে এবং নতুন মেশিন স্থাপন করতে হবে।পাট খাতে বিনিয়োগ ও রফতানি সহায়তা বাড়াতে হবে।সংশ্লিষ্ট রফতানিকারকরা বলছেন, আগামীতে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব।তবে সে সুদিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।

পাট বাংলাদেশের সোনালি আঁশ।বর্তমানে দেশে পাটচাষীর সংখ্যা প্রায় ৪০ লাখ।প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্রায় চার কোটি মানুষের জীবন-জীবিকার সংস্থান হচ্ছে পাট চাষে।পাট শিল্পে ও পাটপণ্য রফতানির কাজে জড়িত আছেন প্রায় ১ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক।জিডিপিতে পাটের অবদান প্রায় শূন্য দশমিক ২০ শতাংশ।কৃষি জিডিপিতে পাটের শরিকানা প্রায় ১ শতাংশ।

মোট রফতানি আয়ের প্রায় ২ শতাংশ উপার্জন হয় পাট ও পাটপণ্য রফতানি থেকে।তৈরি পোশাক শিল্পের পর এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রফতানি খাত।পাট থেকে আহরিত মোট বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় এক-চতুর্থাংশ আসে কাঁচা পাট রফতানি থেকে।এক সময় পাট ও পাটজাত পণ্যই ছিল বাংলাদেশের প্রধান রফতানি খাত।কালক্রমে তা ফিকে হয়ে এসেছে।

তার প্রধান কারণ গার্মেন্টস ও নিটওয়ার শিল্পের দ্রুত প্রসার ও পাট শিল্পের স্থবিরতা।স্বাধীনতার পর ১৯৭২-৭৩ সালে মোট বৈদেশিক আয়ে পাটের হিস্যা ছিল প্রায় ৯০ শতাংশ।২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা নেমে এসেছে ১ দশমিক ৮৮ শতাংশে।তবে পাট ও পাটজাত পণ্য থেকে অর্জিত নিরঙ্কুশ আয় বেড়েছে তিন গুণেরও বেশি।

১৯৭২-৭৩ সালে এ খাত থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রার পরিমাণ ছিল ৩১৩ মিলিয়ন ডলার।২০২৪-২৫ অর্থবছরে তার পরিমাণ দাঁড়ায় ৯০৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলারে।২০২০-২১ অর্থবছর থেকে তা ক্রমাগতভাবে হ্রাস পাচ্ছে।ওই বছর পাট খাতের মোট রফতানি আয় ছিল ১ দশমিক ১৬ বিলিয়ন ডলার।২০২৩-২৪ অর্থবছরে দশমিক ৯২৫ বিলিয়ন এবং ২০২৪-২৫ অর্থবছরে তা দশমিক ৯০৯৭ বিলিয়ন ডলারে নেমে আসে।

একই সঙ্গে হ্রাস পায় পাটপণ্য রফতানির বস্তুগত পরিমাণ।দেশের দ্বিতীয় প্রধান রফতানি খাতের অবদান এভাবে ম্লান হয়ে আসা দেশের অর্থনীতির জন্য শঙ্কার কারণ।প্রধান রফতানি খাত তৈরি পোশাক ও নিটওয়ার শিল্পের সম্প্রসারণের সঙ্গে পাট খাতের রফতানি সম্প্রসারণ করা সম্ভব না হলে মোট রফতানির বহুমুখিতায় বিপত্তি ঘটবে।সেই সঙ্গে গতিশীলতা হারাবে গ্রামীণ অর্থনীতি।

স্মরণাতীতকাল থেকেই বাংলাদেশে পাট চাষ হয়ে আসছে।এটি এক প্রকার দ্বিবীজপত্রী আঁশযুক্ত গাছ।এর ছাল থেকে আসে সোনালি আঁশ, আর ভেতরে থাকে কাঠি।প্রাচীনকালে একে বলা হতো নালিতা।অনেকের মতে উড়িয়া শব্দ ‘ঝুট’ বা সংস্কৃত ‘জট’ শব্দ থেকে ইংরেজি ‘জুট’ শব্দের উৎপত্তি।প্রধানত দুই প্রকার পাট বাণিজ্যে ব্যবহার হয়।

এ দুটি হলো করকরাস ক্যাপসুলারিজ (সাদা) এবং করকরাস অলিটোরিয়াস (তোষা)।সাদা পাটের আদি নিবাস হলো চীন।তোষা পাটের আদি নিবাস হলো মিসর।এ দুই জাতের পাটই বাংলাদেশে আবাদ হয়ে আসছে প্রাচীনকাল থেকে।সাদা পাট হয় নিচু জমিতে।এ পাট পানিসহিষ্ণু।এতে কার্টিংস বা গোড়ার অংশ বেশি। তোষা পাট জলাবদ্ধতা সইতে পারে না।

তাই এর চাষ হয় উঁচু ও মাঝারি উঁচু জমিতে।এ পাটে কার্টিংস বা গোড়ার অংশ কম।এক সময় এ দেশে উৎপাদিত অধিকাংশই ছিল সাদা পাট।এখন তোষা পাটের উৎপাদন বেশি।এছাড়া বাংলাদেশের সমস্যাবহুল মাটিতে কিছু নিম্নমানের পাট কেনাফ (চীন ও থাইল্যান্ড এর উৎপত্তিস্থল) এবং মেস্তা (ভারত এর উৎপত্তিস্থল) চাষ করা হয়।

তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সেন্ট্রাল জুট কমিটির হিসাব মতে, ১৯৫৮ সালে এ দেশে সাদা পাটের আওতাধীন জমির পরিমাণ ছিল শতকরা ৭৫ দশমিক ৪৮ ভাগ এবং তোষা ২৪ দশমিক ৫২ ভাগ।২০২৩-২৪ অর্থবছরে তোষা পাট শতকরা প্রায় ৮৯ ভাগ, সাদা পাট প্রায় ৪ ভাগ এবং মেস্তা ও কেনাফ প্রায় ৭ ভাগ জমিতে চাষ করা হয়।

তোষা পাটের হেক্টরপ্রতি উৎপাদন ১৩ দশমিক ৬৪ বেল, সাদা পাটের উৎপাদন ৯ দশমিক ৭৩ বেল এবং মেস্তা ও কেনাফের গড় উৎপাদন ১০ দশমিক শূন্য ৬ বেল।সারা দেশে হেক্টরপ্রতি পাটের গড় উৎপাদন ১৩ দশমিক ২৪ বেল।উৎকৃষ্টতার দিক থেকে তোষা পাট বেশি মানসম্পন্ন। এর দৈর্ঘ্য, উজ্জ্বলতা, কোমলতা ও মসৃণতা বেশি।বাজারে এর দাম বেশি।

দেশের বিভিন্ন জেলার মাটির ধরন, বৃষ্টিপাত ও আবহাওয়ার পার্থক্যের কারণে পাটের মোট উৎপাদন, গুণাগুণ ও মানের তারতম্য ঘটে।পাট পচানোর ওপর নির্ভর করে এর রঙ ও ঔজ্জ্বল্য।পরিষ্কার ও ধীরে চলমান পানিতে পাট পচালে ও ধুলে এর রঙ ভালো ও উজ্জ্বল হয়।ঘোলা ও বদ্ধ পানিতে পচালে ও ধুলে এর রঙ ময়লা হয়।বর্তমানে আমাদের কৃষকদের বড় সমস্যা পাট পচানো।

বর্ষার পানি দ্রুত নেমে যাওয়ায় এবং প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাবে অনেক সময় ঠিকভাবে পাট জাগ দিতে পারেন না কৃষকরা।পুকুর, ডোবা, খাল, বিল, দিঘি ও নালায় পর্যাপ্ত পানি না থাকায় এ সমস্যা হয় কৃষকদের।বিকল্প হিসেবে রিবন রেটিং বা পাটের ছালকরণ ও পচানো পদ্ধতির শরণাপন্ন হন অনেক কৃষক।তবে এ সম্পর্কে কৃষকদের প্রশিক্ষণের অভাব প্রযুক্তি সম্প্রসারণে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এবার মৌসুমের শুরুতে প্রয়োজনীয় পানির অভাবে পাট জাগ দেয়ার সমস্যা হচ্ছিল।তবে সম্প্রতি পর্যাপ্ত বৃষ্টিতে তা সহজ হয়েছে।পাট বীজের অপ্রতুলতা এ দেশে পাট চাষের আর একটি সমস্যা।দেশে উৎপাদিত বীজে চাষ হয় প্রায় ২০ শতাংশ জমি।বাকি জমির চাষ হয় আমদানীকৃত বীজ দিয়ে, যার গুণগত মান সম্পর্কে অনেক সময় কোনো নিশ্চয়তা থাকে না।

নব্বইয়ের দশকে এ দেশে পাটের চাষ হতো প্রায় ১২ লাখ হেক্টর জমিতে।ক্রমেই তা নেমে আসে সাড়ে চার থেকে পাঁচ লাখ হেক্টরে।অতি সম্প্রতি তা বৃদ্ধি পেয়ে দাঁড়িয়েছে প্রায় সাত থেকে সাড়ে সাত লাখ হেক্টরে।তাছাড়া হেক্টরপ্রতি উৎপাদনও উল্লেখযোগ্য পরিমাণে বেড়েছে।তাতে পাটের মোট উৎপাদন দাঁড়িয়েছে বছরে কম-বেশি ৮০ লাখ বেলে।

২০২৪-২৫ অর্থবছরে পাটের আবাদ হয়েছে ৭ লাখ ৫ হাজার হেক্টর জমিতে।সম্ভাব্য মোট উৎপাদন দাঁড়াবে ৮৫ লাখ বেলে।এ বছর পাটের উৎপাদন ভালো হয়েছে।দামও ভালো পাচ্ছেন কৃষকরা।প্রকারভেদে খামার প্রান্তে প্রতি মণ পাটের দাম পাওয়া যাচ্ছে ৩ হাজার ৫০০ থেকে ৪ হাজার টাকা।পক্ষান্তরে উৎপাদন খরচ ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার টাকা।

প্রতি মণ পাটে কৃষকদের লাভ এবার গড়ে প্রায় ১ হাজার টাকা।পাটের আন্তর্জাতিক মূল্য নির্ধারিত হয় মূলত এফওবি নারায়ণগঞ্জ মূল্যের ভিত্তিতে।সে মোতাবেক এখন প্রতি মণ পাটের এফওবি মূল্য প্রকারভেদে ৪ হাজার ৩০০ থেকে ৫ হাজার ২০০ টাকা।এর প্রায় ৮০ শতাংশই পাচ্ছেন উৎপাদনকারী কৃষক।অভ্যন্তরীণ খরচ ও ব্যবসায়ীদের মুনাফা মিলে যাচ্ছে বাকি প্রায় ২০ শতাংশ।

সেদিক বিবেচনায় এবার পাটের বাজার দক্ষ।তবে সমস্যা রয়েছে পাট রফতানির ক্ষেত্রে।তাতে রফতানি আয় কমছে।এক্ষেত্রে প্রধান সমস্যাটি হচ্ছে পাটপণ্যে সীমিত মূল্য সংযোগ ও বহুধাকরণ।বৈশ্বিক অর্থনৈতিক স্থবিরতার কারণেও পাটপণ্যের চাহিদা বাড়ছে না।অন্যদিকে ভারতের অ্যান্টিডাম্পিং নীতির আরোপ ও শুল্ক বৃদ্ধির কারণে কাঁচা পাট ও পাটপণ্যের রফতানি কমছে।

চোরাপথে অবৈধ রফতানি বৃদ্ধি পাচ্ছে।সম্প্রতি স্থলপথে বাংলাদেশের পাটজাত পণ্য আমদানিতে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করেছে ভারত।আগে বেনাপোল, হিলি এবং ভোমরা স্থলবন্দর দিয়ে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করা হতো ভারতে।তাতে সময় কম লাগত এবং খরচ কম হতো।এখন মুম্বাইয়ের নাভা শেভা সমুদ্রবন্দর দিয়ে তা রফতানি করতে হবে।

তাতে সময় লাগবে বেশি।খরচ বাড়বে।বাংলাদেশ থেকে ২০২৩-২৪ অর্থবছরে ১৫৭ কোটি ডলারের পাটপণ্য রফতানি হয়েছে ভারতে, যা মোট রফতানির ৩ দশমিক ৭৫ শতাংশ।এর মাত্র ১ শতাংশ রফতানি হতো সমুদ্রপথে।এখন পুরোটাই নোঙর করবে মোম্বাই সমুদ্রবন্দরে।তাতে বাংলাদেশের পণ্য প্রতিযোগিতার সক্ষমতা হারাবে।

দেশের অভ্যন্তরেও পাটপণ্য রফতানির ক্ষেত্রে অনেক সমস্যা বিদ্যমান।এবারের বাজেটে কাঁচা পাট রফতানির ক্ষেত্রে শূন্য দশমিক ৫ শতাংশ উৎসে কর আরোপ করা হয়েছে।নগদ সহায়তার ওপর প্রবর্তন করা হয়েছে ১০ শতাংশ কর।বহুমুখী পাটপণ্যের ক্ষেত্রে নগদ সহায়তা ১৫ থেকে কমিয়ে ১০ শতাংশ করা হয়েছে।সাধারণ পাটপণ্যের ক্ষেত্রে রফতানি সহায়তা ৭ থেকে কমিয়ে নির্ধারণ করা হয়েছে ৫ শতাংশ।

পাটের সুতা রফতানিতে আগে ৫ শতাংশ নগদ সহায়তা দেয়া হতো, এখন তা ৩ শতাংশে নামানো হয়েছে।এগুলো পাট রফতানিকে নিরুৎসাহিত করবে।আগামী দিনগুলোয় পাট খাতের রফতানি বাড়ানোর জন্য পাটপণ্যের বহুধারণ নিশ্চিত করতে হবে।রফতানির গন্তব্য সম্প্রসারিত করতে হবে।ভারতের বিভিন্ন শুল্ক ও অশুল্ক বাধার বিষয়ে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার আয়োজন করতে হবে।

একই সঙ্গে বিকল্প বাজার খোঁজার উদ্যোগ নিতে হবে।অভ্যন্তরীণভাবে পাটপণ্যের ওপর বিভিন্ন কর রহিত করতে হবে।পাট শিল্পের আধুনিকায়ন নিশ্চিত করতে হবে এবং নতুন মেশিন স্থাপন করতে হবে।পাট খাতে বিনিয়োগ ও রফতানি সহায়তা বাড়াতে হবে।সংশ্লিষ্ট রফতানিকারকরা বলছেন, আগামীতে পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানি করে বছরে প্রায় ৫ বিলিয়ন ডলার আয় করা সম্ভব।

তবে সে সুদিনের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।পাট গবেষণার ক্ষেত্রে বাংলাদেশের অনেক সাফল্য আছে।এ নাগাদ সাদা পাটের ১২টি উচ্চফলনশীল জাত পাওয়া গেছে।তোষা পাটের আটটি, কেনাফের চারটি ও মেস্তার তিনটি উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবন ও অবমুক্ত করা হয়েছে।এগুলোর সম্প্রসারণ চলছে মাঠ পর্যায়ে।বর্তমানে পাটের গড় ফলন পৃথিবীর পাট উৎপাদনকারী দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশেই বেশি।

গত অর্ধশতাব্দী ধরে এ দেশে পাটের ফলন বেড়েছে উল্লেখযোগ্য মাত্রায়।এর পেছনে কৃষি বিজ্ঞানীদের এবং বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউটের অবদান অনস্বীকার্য।সম্প্রতি পাটের বংশগতিবিন্যাস (জেনোম সিকুয়েন্স) উদ্ভাবন হয়েছে।তাতে রোগ ও পোকা প্রতিরোধক আরো উচ্চফলনশীল জাত উদ্ভাবনের সম্ভাবনা উন্মোচিত হয়েছে।

বর্তমানে বৈশ্বিক উষ্ণায়ন ও আবহাওয়া পরিবর্তনের ফলে এ দেশে কৃষি পরিবেশের দ্রুত পরিবর্তন হচ্ছে।এখন আমাদের এমন পাটের জাত উদ্ভাবন করতে হবে যা খরা, লবণাক্ততা ও শীতসহিষ্ণু।সারা বছর উৎপাদন উপযোগী পাটজাত উদ্ভাবন এখন সময়ের দাবি।এরই মধ্যে বছরে দুবার অর্থাৎ ফেব্রুয়ারি ও মে মাসে পাট বোনার সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে।

তাতে পাটের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে।তবে গবেষণার মাঠে নতুন উদ্ভাবিত পাট জাতের ফলন যত বেশি, কৃষকের মাঠে তত বেশি নয়।গবেষণা ও কৃষকের মাঠে প্রাপ্ত উৎপাদনে প্রায় ৪০ শতাংশ ফারাক বিদ্যমান।এটি কমাতে হবে।এর জন্য গবেষণা ও সম্প্রসারণের মধ্যে জোরালো সমন্বয় প্রয়োজন। পাট গবেষণা ও সম্প্রসারণে বিনিয়োগ বাড়ানো প্রয়োজন৷

বাংলাদেশে পাটের ব্যবহার নানাবিধ।প্রথমে এর ব্যবহার ছিল সবজি হিসেবে।তখন পাটপাতা ছিল দরিদ্রের খাদ্য।প্রাচীন গ্রিসদের কাছে পাট করকরাস নামে পরিচিত ছিল।এর অর্থ চক্ষুরোগ বিনাশক।তাতে বোঝা যায়, ঔষধি গুণের জন্যও পাটের আবাদ হতো।প্রাচীনকালে রচিত মহাভারতে পাটবস্ত্রের উল্লেখ থাকায় তখন থেকেই বয়নযোগ্য আঁশ হিসেবে পাটের ব্যবহারের সন্ধান পাওয়া যায়।

মধ্যযুগের সাহিত্যেও পাটবস্ত্রের প্রচুর উল্লেখ আছে।গৃহস্থালির কাজেও পাট ও পাটকাঠির ব্যবহার জনপ্রিয় ছিল সুদূর অতীত থেকেই।অর্থাৎ বাংলাদেশে পাট চাষ, পাটনীতি, পাটদ্রব্য উৎপাদন ও এর ব্যবহার এবং বাণিজ্যিক ইতিহাস সুপ্রাচীন।তবে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে এর বাণিজ্যিক প্রসার ঘটে আঠারো শতকে।এ দেশে ইংরেজ রাজত্ব প্রতিষ্ঠার পর থেকে ইউরোপীয়দের দৃষ্টি আকর্ষণ করে আমাদের পাটের আঁশ ও পাটজাত দ্রব্য।

ক্রমেই পাটের বহির্বাণিজ্য বিকাশ লাভ করে।২০২১ সালে বিশ্বে পাটের মোট উৎপাদন ছিল ৩ দশমিক ৪৬ মিলিয়ন টন।ভারতের উৎপাদন ছিল ১ দশমিক ৭২ মিলিয়ন টন এবং বাংলাদেশের উৎপাদন ছিল ১ দশমিক ৬৮ মিলিয়ন টন।বাংলাদেশ ও ভারত মিলে বিশ্বের প্রায় ৯৮ শতাংশ পাট উৎপাদন নিয়ন্ত্রণ করছে।গত ১৫ বছরে বাংলাদেশে পাট উৎপাদন প্রায় ৬ শতাংশ হারে বৃদ্ধি পেয়েছে।

\আবাদি জমির পরিমাণ বেড়েছে ৪ দশমিক ৪ শতাংশ হারে।হেক্টর প্রতি পাটের ফলনও বেড়েছে উল্লেখযোগ্য হারে।পাট ও পাটজাত পণ্য রফতানির ক্ষেত্রে বিশ্ববাজারে এখনো বাংলাদেশের আধিপত্য বিরাজমান।বিশ্বের মোট পাট রফতানির ৭৯ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে বাংলাদেশ।তাছাড়া ভারত ৪ দশমিক ৮ শতাংশ এবং তাঞ্জানিয়া, বেলজিয়াম, কেনিয়া ও মালয়েশিয়া মিলে ১৩ শতাংশ নিয়ন্ত্রণ করে থাকে।

কাঁচা পাট রফতানির ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শরিকানা ৯৭ শতাংশ এবং পাটজাত দ্রব্যের ক্ষেত্রে ৬০ শতাংশেরও বেশি।বাংলাদেশী কাঁচা পাট প্রধানত রফতানি করা হয় ভারত, পাকিস্তান, চীন, ইউরোপ, আইভরিকোস্ট, থাইল্যান্ড এবং অন্যান্য দেশে।পাটজাত দ্রব্য রফতানি হয় ইউরোপ, তুরস্ক, ইরাক, সিরিয়া, মিসর, অস্ট্রেলিয়া, সৌদি আরব, জাপান, সুদান, ঘানা, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ ১৩৫টি দেশে।

বর্তমানে পাটের বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ সৃষ্টি হয়েছে পৃথিবীর আরো অনেক দেশে।তার কারণ পলিথিন ও সিনথেটিকের ব্যবহার বিশ্বব্যাপী নিরুৎসাহিত করছেন পরিবেশবাদীরা।পলিথিন ও সিনথেটিক দ্রব্য পচনশীল নয়।পরিবেশের জন্য এগুলো মারাত্মক ক্ষতিকর।অন্যদিকে পাট পরিবেশবান্ধব।তাই এর চাহিদা রয়েছে বিশ্বব্যাপী।

তাছাড়া অভ্যন্তরীণ বাজারেও পাটের চাহিদা বৃদ্ধি পাচ্ছে ১৯টি পণ্যের মোড়কে পাটের ব্যাগ/থলে/বস্তা ব্যবহারের আইন প্রণয়ন করার কারণে।তবে আইনটি সব ক্ষেত্রে এখনো প্রয়োগ করা সম্ভব হয়নি।আগামীতে পাটের উৎপাদন, অভ্যন্তরীণ ব্যবহার ও রফতানি আয় লাগাতার বৃদ্ধি পাবে—এ প্রত্যাশা।

IPCS News : Dhaka : আবুল কালাম আজাদ : রাজশাহী।