নেপালে ‘বালিশ কাণ্ড’–ধাঁচের দুর্নীতি: পোখরা বিমানবন্দর প্রকল্পে ৮৩৬ কোটি রুপি লেনদেনের অভিযোগ
আপডেটঃ ১১:৫৮ পূর্বাহ্ণ | ডিসেম্বর ১০, ২০২৫
নিউজ ডেস্কঃ
নেপালে সরকারি ব্যয়ের অনিয়ম নিয়ে বড় ধরনের কেলেঙ্কারি সামনে এসেছে, যা বাংলাদেশের রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের আলোচিত ‘বালিশ কাণ্ডে’র সঙ্গে তুলনা টেনে দেশটিতে ব্যাপক আলোচনা সৃষ্টি করেছে। রূপপুর প্রকল্পে বালিশের দাম অতিরিক্ত দেখিয়ে যেভাবে তোলপাড় হয়েছিল, ঠিক একই ধরনের অস্বাভাবিক ব্যয় বৃদ্ধির অভিযোগ এবার ওঠেছে পোখরা আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর নির্মাণ প্রকল্পে।
চীনা অর্থায়নে নির্মিত এই প্রকল্পে ব্যয় কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে বিপুল পরিমাণ অর্থ লেনদেনের অভিযোগ এনেছে নেপালের দুর্নীতি তদন্ত কমিশন। রোববার দায়ের করা মামলায় পাঁচ সাবেক মন্ত্রী, ১০ সাবেক সচিবসহ মোট ৫৫ জন ব্যক্তি ও একটি কোম্পানিকে অভিযুক্ত করা হয়েছে। অভিযোগে বলা হয়েছে, প্রকল্পের ব্যয় হিসাব ‘ইচ্ছাকৃতভাবে’ বড় করে দেখানো হয় এবং প্রায় ৭ কোটি ৪৩ লাখ মার্কিন ডলার—বাংলাদেশি টাকায় যা হাজার কোটি টাকারও বেশি—অনিয়মের মাধ্যমে লেনদেন করা হয়েছে। নগদ হিসাবের ওপর ভিত্তি করে এটিই নেপালের বিশেষ আদালতে করা সবচেয়ে বড় দুর্নীতি মামলা বলে রিপোর্ট করেছে কাঠমান্ডু পোস্ট।
অভিযোগপত্রে বলা হয়, বিমানবন্দর নির্মাণের জন্য অনুমোদিত মোট ব্যয় ‘ক্ষতিকর উদ্দেশ্যে’ সংশোধন করা হয়। ২০১৮ সালের ১০ আগস্টের বিনিময় হার অনুযায়ী ৭ কোটি ৪৩ লাখ ডলার প্রায় ৮৩৬ কোটি নেপালি রুপির সমান, যা প্রকল্পের আসল মূল্যায়নের তুলনায় অস্বাভাবিকভাবে বেশি। তদন্তে দেখা গেছে, ব্যয় নির্ধারণ, দরপত্র আহ্বান, পরামর্শক নিয়োগ—সব ক্ষেত্রেই গড়েছে অনিয়মের ছড়িয়ে থাকা জাল।
পোখরা বিমানবন্দর প্রকল্পটি শুরু থেকেই রাজনৈতিক টানাপড়েন, গোপন চুক্তি এবং অস্বচ্ছ দরপত্র প্রক্রিয়ার মধ্যে ছিল। ১৯৭৫ সালে জমি অধিগ্রহণের পর বহু দফায় পরিকল্পনা পরিবর্তন ও স্থবিরতার মধ্য দিয়ে প্রকল্পটি এগিয়েছে। দুর্নীতি বিরোধী কমিশনের ভাষ্য, বহু পর্যায়ে সচেতনভাবে ভুল তথ্য উপস্থাপন করা হয়, যা প্রকল্প ব্যয় অযৌক্তিকভাবে বাড়ানোর ভিত্তি তৈরি করে।
চীনা কোম্পানি চায়না সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং–এর কার্যক্রম নিয়েও গুরুতর প্রশ্ন তুলেছে কমিশন। অভিযোগে বলা হয়, প্রতিষ্ঠানটি শুরু থেকেই ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে’ প্রকল্পটি নিজেদের নিয়ন্ত্রণে নেওয়ার চেষ্টা করেছে। ২০১১ সালে তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বার্ষা মান পুন সিএএমসির সঙ্গে গোপনে একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেন—যা পরে সংসদীয় কমিটির নজরে আসে এবং প্রকল্প স্থগিত হয়ে যায়।
২০১২ থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে দরপত্র ও ব্যয় মূল্যায়নে ‘বিশেষ সুবিধা’ নিশ্চিত করা হয় চীনা প্রতিষ্ঠানটিকে। প্রথমে সিএএমসি প্রায় ৩০ কোটি ৫০ লাখ ডলার প্রস্তাব দেয়, যেখানে নেপাল সরকারের হিসাব ছিল মাত্র ১৬ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। সমালোচনার পর ব্যয় নামিয়ে আনা হলেও প্রকল্পটি শেষ পর্যন্ত ২১ কোটি ৫৯ লাখ ডলারে অনুমোদন পায়—যা এখন বিশাল দুর্নীতির অভিযোগে ঘিরে ধরেছে সংশ্লিষ্টদের।
তদন্তে আরও উঠে এসেছে, প্রকল্প ব্যয় বাড়ানোর উদ্দেশ্যে প্রযুক্তিগত সমীক্ষাগুলো ইচ্ছাকৃতভাবে ভুলভাবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এসব প্রতিবেদনের সঙ্গে জড়িত ছিলেন কয়েকজন বিশেষজ্ঞও, যাদের নাম অভিযোগপত্রে স্থান পেয়েছে।
অভিযুক্তদের তালিকায় সাবেক পর্যটনমন্ত্রী পোস্ত বাহাদুর বোগাটি, ভীম প্রসাদ আচার্য, রাম কুমার শ্রেষ্ঠ, দীপক চন্দ্র আমাত্য এবং সাবেক অর্থমন্ত্রী রাম শরণ মহাতসহ নেপালের শীর্ষ পর্যায়ের নীতি-নির্ধারকরা রয়েছেন। এ ছাড়া চায়না সিএএমসি ইঞ্জিনিয়ারিং–এর চেয়ারম্যান ওয়াং বো এবং আঞ্চলিক জেনারেল ম্যানেজার লিউ শেংচেংকে অভিযুক্ত করা হয়েছে, যারা প্রকল্প পরিচালনার মূল দায়িত্বে ছিলেন।
এই কেলেঙ্কারি প্রকাশ্যে আসার পর নেপালে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি হয়েছে। রাজনৈতিক মহল থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষের মধ্যেও ক্ষোভ বাড়ছে। বিশেষজ্ঞদের মতে, এটি শুধু আর্থিক অনিয়ম নয়—রাষ্ট্রীয় প্রকল্প ব্যবস্থাপনায় দীর্ঘদিনের অস্বচ্ছতার ভয়াবহ চিত্রও স্পষ্ট করে তুলেছে।
IPCS News : Dhaka :

