শুক্রবার ৪ঠা জুলাই, ২০২৫ খ্রিস্টাব্দ ২০শে আষাঢ়, ১৪৩২ বঙ্গাব্দ

সংবাদ শিরোনামঃ

ছয় মরদেহ পোড়ানোর অভিযোগে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাসহ ১৬ জনের বিরুদ্ধে চার্জশিট

আপডেটঃ ১১:৪৮ পূর্বাহ্ণ | জুলাই ০২, ২০২৫

নিউজ ডেস্কঃ

আশুলিয়ায় ৬ জনকে গুলি করে হত্যার পর তাঁদের মরদেহ একটি পুলিশ ভ্যানে তুলে পুড়িয়ে ফেলার ঘটনায় ১৬ জনকে আসামি করে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে আনুষ্ঠানিক অভিযোগ দাখিল করা হয়েছে। দীর্ঘ তদন্ত শেষে প্রসিকিউশনের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার সকালে ট্রাইব্যুনালে এই অভিযোগপত্র জমা দেওয়া হয়। এই মামলাটি শুধু একটি জঘন্য হত্যাকাণ্ড নয়, এটি একটি পরিকল্পিত মানবতাবিরোধী অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে, যেখানে রাষ্ট্রীয় কর্তৃত্ব ব্যবহারের মাধ্যমে একটি সংঘটিত হত্যাযজ্ঞ আড়াল করার চেষ্টা করা হয়।

২০২৪ সালের ৫ আগস্ট সাভারের আশুলিয়া এলাকায় এক আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে ছয়জন নিহত হন বলে স্থানীয়রা জানান। তারা আরও দাবি করেন, নিহতদের মরদেহ ওই রাতেই একটি পুলিশ ভ্যানে তোলা হয় এবং পরে তা পেট্রোল ঢেলে পুড়িয়ে ফেলা হয়। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, মরদেহ পোড়ানোর সময় অন্তত একজন ব্যক্তি জীবিত ছিলেন। সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া একটি ভিডিওতেও দেখা যায়, একটি মরদেহ সামান্য নড়াচড়া করছে এবং আগুনের মধ্যে একজন মানুষের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। এই ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ার পর ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি হয় এবং মানবাধিকার সংগঠনগুলো ঘটনার নিরপেক্ষ তদন্তের দাবি জানায়।

এই ঘটনার তদন্তে নাম আসে পুলিশের উচ্চপদস্থ কয়েকজন কর্মকর্তার, যাঁরা ঘটনার সময় ঘটনাস্থলে উপস্থিত ছিলেন কিংবা পরে ঘটনাটি ধামাচাপা দেওয়ার পেছনে ভূমিকা রেখেছেন বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়েছে। অভিযুক্তদের মধ্যে রয়েছেন তৎকালীন অতিরিক্ত উপ-পুলিশ কমিশনার (ADC), সাভার সার্কেলের সহকারী পুলিশ সুপার, আশুলিয়া থানার ওসি, ডিবি ইন্সপেক্টর, একাধিক এসআই এবং কনস্টেবল। এদের মধ্যে কয়েকজন বর্তমানে চাকরিতে আছেন, আবার কয়েকজন ইতিমধ্যে সাসপেন্ড হয়েছেন বা পলাতক রয়েছেন। এছাড়াও স্থানীয় এক রাজনৈতিক নেতার নামও আসামির তালিকায় রয়েছে, যিনি পরিস্থিতি উত্তপ্ত করতে সহায়তা করেছেন বলে অভিযোগপত্রে বলা হয়েছে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রধান প্রসিকিউটর মোহাম্মদ তাজুল ইসলাম সাংবাদিকদের জানান, এই ঘটনার তদন্তে বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ প্রমাণ উদ্ধার হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ভিডিও ফুটেজ, প্রত্যক্ষদর্শীদের জবানবন্দি, ফরেনসিক রিপোর্ট এবং পুলিশের যোগাযোগ রেকর্ড। তিনি বলেন, এমন নৃশংস ও পৈশাচিক ঘটনা এর আগে তারা কখনও দেখেননি। তদন্তে একাধিক নির্ভরযোগ্য সূত্র নিশ্চিত করেছে যে ঘটনাটি ছিল সুপরিকল্পিত এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তাদের প্রত্যক্ষ মদদে সংঘটিত হয়েছে।

তদন্ত দল জানায়, নিহতদের পরিবারের সদস্যরা প্রথমে স্থানীয় থানায় অভিযোগ করতে গেলে পুলিশ তা গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি জানায়। পরে বিষয়টি আদালতের নির্দেশে তদন্ত সংস্থার কাছে যায়। প্রাথমিকভাবে দুইটি পৃথক অভিযোগ দায়ের করা হলেও পরবর্তীতে সেগুলো একত্রিত করে একটি মামলায় রূপান্তর করা হয়। মামলার গুরুত্ব অনুধাবন করে তদন্ত সংস্থা এবং প্রসিকিউটরদের সমন্বয়ে একটি বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করা হয়। তদন্তের সময় বিভিন্ন জায়গা থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা হয়, এমনকি কিছু প্রত্যক্ষদর্শীকে দেশের বাইরে গিয়েও জিজ্ঞাসাবাদ করা হয়েছে।

এ ঘটনার প্রতিবাদে গত এক বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে মানববন্ধন ও বিক্ষোভ অনুষ্ঠিত হয়েছে। নিহতদের পরিবার একাধিকবার প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির দপ্তরে স্মারকলিপি প্রদান করেছে। সামাজিক মাধ্যমে এই ঘটনা নিয়ে ব্যাপক ক্ষোভের সৃষ্টি হয়। অনেকেই প্রশ্ন তোলেন— পুলিশ যদি এমন নৃশংস কাজ করতে পারে এবং তা ধামাচাপা দেওয়ার চেষ্টা করে, তাহলে সাধারণ মানুষ কোথায় নিরাপদ?

মঙ্গলবার অভিযোগপত্র দাখিলের পর ট্রাইব্যুনাল বিষয়টি গ্রহণ করবেন কিনা, সে সিদ্ধান্ত দেবেন। অভিযোগ গঠন হলে পরবর্তী ধাপে সাক্ষ্যগ্রহণ ও বিচার কাজ শুরু হবে। প্রসিকিউশনের আশা, দ্রুত বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করা যাবে। অভিযুক্তদের মধ্যে যারা এখনও গ্রেপ্তার হয়নি, তাদের বিরুদ্ধে গ্রেপ্তারি পরোয়ানা জারির প্রস্তুতি চলছে।

এই মামলা শুধু ছয়টি জীবনহানির বিচার নয়, বরং এটি রাষ্ট্রের ভেতরে জবাবদিহিতা ও ন্যায়বিচারের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষা হয়ে উঠেছে। অনেকেই মনে করছেন, এই ঘটনার সুষ্ঠু বিচার হলে ভবিষ্যতে পুলিশ ও প্রশাসনের মধ্যে স্বেচ্ছাচারিতা কমবে এবং জনগণের আস্থা কিছুটা হলেও ফিরে আসবে। নিহতদের পরিবার বলছে, তারা কারও বিরুদ্ধে মিথ্যা অভিযোগ আনেনি, শুধু চায়— যারা এই নৃশংসতা চালিয়েছে, তাদের কঠোর শাস্তি হোক। তারা আর বিচারহীনতার সংস্কৃতি দেখতে চায় না।

এই মুহূর্তে আশুলিয়ার সেই স্থানটি নিঃশব্দ ও থমথমে। কিন্তু নিহতদের পরিবার এবং সাধারণ মানুষ অপেক্ষা করছে— রাষ্ট্র এবার কি সত্যিই ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে পারবে?

IPCS News : Dhaka :