আইন, রাজনীতি ও বাস্তবতা: অন্তর্বর্তী সরকার প্রশ্নে ত্রিমাত্রিক সংকট
আপডেটঃ ১১:৫৬ পূর্বাহ্ণ | মে ২৪, ২০২৫

নিউজ ডেস্কঃ
আগামী জাতীয় নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে উত্তাপ বেড়েই চলেছে।বিরোধী দলগুলোর পক্ষ থেকে নির্বাচনের আগে একটি নিরপেক্ষ অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের দাবি পুনরায় জোরালোভাবে উত্থাপিত হয়েছে।এই প্রস্তাব যেমন রাজনৈতিক দোলাচল সৃষ্টি করেছে, তেমনি এটি বাস্তবায়নের পথে একাধিক সংবিধানিক ও আইনি প্রশ্নকে সামনে নিয়ে এসেছে।আইন বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, অন্তর্বর্তী সরকার পুনর্গঠনের প্রশ্নটি শুধু রাজনৈতিক ইচ্ছাশক্তির বিষয় নয়, এটি বাংলাদেশের বিদ্যমান আইনি কাঠামো এবং সংবিধানের মূল কাঠামোর সাথেও গভীরভাবে জড়িত।
২০১১ সালে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর মাধ্যমে বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনকারী তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করা হয়।এই পরিবর্তনের ফলে সংবিধানে নির্বাচনের সময়কালীন একটি নিরপেক্ষ বা অন্তর্বর্তী সরকারের জন্য কোনো ব্যবস্থা রাখা হয়নি। বর্তমানে ক্ষমতাসীন দলই নির্বাচনকালীন সরকার হিসেবে দায়িত্ব পালন করে থাকে।কিন্তু এই ব্যবস্থার নিরপেক্ষতা নিয়ে বিরোধী দলগুলো দীর্ঘদিন ধরেই প্রশ্ন তুলে আসছে।তারা দাবি করে, বর্তমান ব্যবস্থায় নির্বাচন কমিশন এবং প্রশাসন সরকারের প্রভাবমুক্ত থেকে কাজ করতে পারে না।এই প্রেক্ষাপটে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাব নতুন করে সামনে এসেছে।
তবে এমন একটি সরকার পুনর্গঠন করতে হলে তা সংবিধান মোতাবেক কীভাবে সম্ভব হবে, সেটি নিয়ে মতবিরোধ রয়েছে।একদিকে সংবিধানে এমন কোনো ধারা নেই যা নির্বাচনকালীন একটি বিশেষ সরকার গঠনের অনুমোদন দেয়, অন্যদিকে সংবিধানের মৌলিক কাঠামো পরিবর্তন করা সাংবিধানিকভাবে সংরক্ষিত।আইন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, যদি অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের জন্য নতুন কোনো আইনি কাঠামো প্রণয়নের চেষ্টা করা হয়, তবে তা সংবিধানের সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়তে পারে।এক্ষেত্রে বিষয়টি আদালতে গড়ালে, উচ্চ আদালত এটি বাতিল করে দিতে পারে বা সীমিত ক্ষমতাসম্পন্ন একটি কাঠামোর অনুমোদন দিতে পারে।
এছাড়া অন্তর্বর্তী সরকারের কার্যপরিধি কী হবে, সেটি নিয়েও রয়েছে বড় প্রশ্ন।এমন সরকারের অধীনে কি শুধু নির্বাচন কমিশনের সহায়ক প্রশাসনিক কার্যক্রম চলবে, নাকি রাষ্ট্র পরিচালনার বৃহত্তর দায়িত্বও তাদের হাতে থাকবে? নিরাপত্তা বাহিনী, অর্থবিভাগ, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে কোন ভূমিকা থাকবে এই সরকারের? এ বিষয়ে পরিষ্কার রূপরেখা না থাকলে সরকারের স্থবিরতা বা ক্ষমতার দ্বন্দ্ব দেখা দিতে পারে। একটি অন্তর্বর্তী সরকার সীমিত ক্ষমতার অধিকারী হবে কি না, সেটিও নির্ভর করবে রাজনৈতিক সমঝোতা ও আদালতের সিদ্ধান্তের ওপর।
সংবিধান ছাড়াও একটি অন্তর্বর্তী সরকারের গঠন ও কার্যকারিতাকে কেন্দ্র করে অন্যান্য আইন ও বিধিমালাও সংশোধনের প্রয়োজন হতে পারে। রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা, মন্ত্রিসভা গঠনের বিধান, প্রশাসনিক নিয়োগসহ বিভিন্ন বিষয়ে বিদ্যমান আইনসমূহে পরিবর্তন আনতে হলে তা সময়সাপেক্ষ ও রাজনৈতিক ঐকমত্যসাপেক্ষ।
তবে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ রাজনৈতিক ঐকমত্যের অভাব। বর্তমানে শাসক দল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রস্তাবকে একটি “সংবিধানবিরোধী” দাবি হিসেবে দেখছে, অপরদিকে বিরোধী জোট এটিকে অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের পূর্বশর্ত হিসেবে উপস্থাপন করছে। দুই পক্ষের মধ্যে আস্থার ঘাটতি ও মতবিরোধের পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনার টেবিলে সমঝোতা দেখা যাচ্ছে না। এই পরিস্থিতিতে কোনো প্রক্রিয়ায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের চেষ্টা নেয়া হলে তা রাজনৈতিক অস্থিরতা আরও বাড়াতে পারে।
আইনবিদ ও রাজনীতি বিশ্লেষকরা মনে করেন, এই ধরনের সরকার গঠনের উদ্যোগ বাস্তবায়নের আগে দরকার একটি সর্বদলীয় সংলাপ, যেখানে নির্বাচনের রূপরেখা, প্রশাসনের নিরপেক্ষতা, ও সংবিধান অনুযায়ী বৈধ কাঠামোর মধ্যে থেকে সমাধানের পথ খোঁজা হবে। অন্যথায় অন্তর্বর্তী সরকার গঠনের যেকোনো একতরফা প্রচেষ্টা একদিকে যেমন আইনি চ্যালেঞ্জের মুখে পড়বে, অন্যদিকে দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতাকেও হুমকির মুখে ফেলবে।
সুতরাং, অন্তর্বর্তী সরকার পুনর্গঠনের ভাবনা যতই রাজনৈতিকভাবে জনপ্রিয় হোক না কেন, এটি বাস্তবায়নের পথ জটিল ও বহুস্তরীয়। সংবিধান, আইন, আদালত, প্রশাসন এবং রাজনৈতিক দলগুলোর সম্মিলিত সিদ্ধান্ত ছাড়া এই পথে এগোনো শুধু কঠিনই নয়, ভবিষ্যতের জন্য বিপজ্জনকও হতে পারে।
IPCS News : Dhaka :