শনিবার ২০শে এপ্রিল, ২০২৪ খ্রিস্টাব্দ ৭ই বৈশাখ, ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংবাদ শিরোনামঃ

রাজশাহীতে ‘ঘুষ’ এর বিনিময়ে আউটসোর্সিং এ চাকরি দিয়ে ‘ভয়ঙ্কর প্রতারণা

আপডেটঃ ২:০২ অপরাহ্ণ | সেপ্টেম্বর ১৩, ২০২২

নিউজ ডেস্কঃ

রাজশাহী:– রাজশাহীতে রাজস্ব খাতভুক্ত আউট সোর্সিং এ ঘুষের বিনিময়ে নিয়োগ প্রাপ্ত কর্মচারীদের বেতনভাতা না দিয়ে ‘বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড’ নামের ঢাকার একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে ‘ভয়ঙ্কর প্রতারণার’ অভিযোগ উঠেছে।শুধু তাই নয়; রাজশাহী সিভিল সার্জনের আওতায় ২০২১-২০২২ অর্ধবছরের শেষ তিন মাসের জন্য স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ‘আউট সোর্সিং’ এর মাধ্যমে জনবল নিয়োগের যে প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছিলো গত ৩০ জুন সেটির মেয়াদও শেষ হয়ে গেছে।অথচ মেয়াদ শেষ হওয়ার পরও টাকার বিনিময়ে ওই প্রকল্পেই জনবল নিয়োগ দেয়ার বিস্তর অভিযোগ উঠেছে।তাদেরকে চতুর্থ শ্রেণির বিভিন্ন পদে নিয়োগ দিয়ে মাসের পর মাস বেতন না দিয়েই খাটানো হচ্ছে।সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, ২০২১-২০২২ অর্ধবছরে রাজশাহী সিভিল সার্জনের মাধ্যমে রাজস্ব খাতভুক্ত আউট সোর্সিং হিসেবে অনুমোদিত ৮৬টি পদে চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারী নিয়োগের একটি প্রশাসনিক অনুমোদন দিয়েছিলো স্বাস্থ্য অধিদপ্তর।

গত ৩১ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের প্রশাসনিক এই অনুমোদনের পরিপ্রেক্ষিতে পুনঃদরপত্রের মাধ্যমে ‘বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিস’ নামের একটি ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান এসব জনবল নিয়োগের অনুমোদন পায়।কিন্তু শুরু থেকেই এই ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে ঘুষের মাধ্যমে জনবল নিয়োগের অভিযোগ ওঠে।

গত ৩১ মার্চ স্বাস্থ্য অধিদপ্তর থেকে রাজশাহী সিভিল সার্জনকে পাঠানো ‘আউট সোর্সিং এর মাধ্যমে জনবল নিয়োগ’ এর প্রশাসনিক অনুমোদনপত্রে (স্মারক নং-স্বাঃ অধিঃ হিসাব/আউট সোর্সিং জনবল/প্রশা.অনু./সিভিল সার্জন রাজশাহী/২০২১-২০২২/৫৩১) উল্লেখ আছে, ২০২১-২০২২ অর্থ বছরে ‘আউট সোর্সিং এর মাধ্যমে জনবল নিয়োগ’ এর উন্মুক্ত দরপত্র/চুক্তি প্রশাসনিক অনুমোদন প্রদানের তারিখ (৩১ মার্চ ২০২২) থেকে কার্যকর হবে এবং ৩০ জুন ২০২২ পর্যন্ত বলবৎ থাকবে।স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় স্মারক নং-১৩৯৩ (তারিখ : ১৩ নভেম্বর ২০২১) এ প্রদত্ত নির্দেশনা মোতাবেক অত্র দরপত্রে প্রশাসনিক অনুমোদনের মেয়াদ বৃদ্ধি করার কোনো সুযোগ নেই।

এজন্য স্থানীয় ক্রয়কারী কর্তৃপক্ষ (সিভিল সার্জন) কার্যাদেশের মেয়াদ ৩০ জুন ২০২২ ইং তারিখ অতিক্রান্ত হওয়ার ৬ মাস পূর্বে রাজশাহী সিভিল সার্জন- স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের স্মারক নং- ২২ (২৫ জুলাই ২০২১) এর সংযুক্তি (গ) মোতাবেক তথ্যাদি প্রদানসহ স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় কর্তৃক পদ সমূহের (৮৬ জন) প্রশাসনিক অনুমোদন প্রাপ্তি সাপেক্ষে ২০২২-২০২৩ অর্থবছরে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে জনবল নিয়োগ দিয়ে সেবা কার্যক্রম চলমান রাখবেন।

তবে অনুসন্ধানে জানা গেছে, ‘বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড’ নামের ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পদে রাজশাহী সদরসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ৮৬ জন জনবল সরবরাহের প্রশাসনিক অনুমোদন পাওয়ার পরই প্রতিষ্ঠানটি প্রায় অর্ধেক জনবলকে টাকার (ঘুষ) বিনিময়ে নিয়োগ দেয় বলে অভিযোগ ওঠে।

নিয়োগ দেয়া এসব কর্মচারীকে এনআরবিসি ব্যাংকের রাজশাহী শাখায় একাউন্ট (হিসাব নম্বর) খুলতে বলে।নিয়ম অনুযায়ী, কর্মচারীরা নিজের নামে একাউন্ট খোলেন। কিন্তু স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের বিধিমালা অনুযায়ী- নিয়োগকৃতদের মাস শেষে বেতন পরিশোধের কথা থাকলেও ৩০ জুন (প্রকল্পের মেয়াদ) পর্যন্ত কাউকেই বেতন দেয়নি।

পরে ২০২১-২০২২ অর্থবছরের মেয়াদ শেষ হলে কর্মচারীরা বেতনের জন্য চাপ দেয়।তখন ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানটি কর্মীদের ব্যাংক হিসাবের বহি জমা নেয় এবং প্রত্যেকের থেকে তিন মাসের বেতন দেয়া হবে মর্মে তিনটি চেকে স্বাক্ষর করিয়ে নেয়।তবে অদ্যাবধি কোনো কর্মচারীই তিন মাসের বেতন পাননি।

শুধু তাই নয়; স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেয়া জনবল নিয়োগের প্রশাসনিক অনুমোদনপত্রে উল্লেখিত মেয়াদ গত ৩০ জুন অতিবাহিত হয়েছে।অথচ এখন পর্যন্ত কর্মীদের কোনো বেতন-ভাতা না দিয়েই স্বীয় পদে কর্মরত রাখা হয়েছে।মেয়াদ শেষের পরও প্রতিষ্ঠানটি টাকার বিনিময়ে নতুন করে জনবল নিয়োগ দিয়ে পদায়ন করেছে।

তানোর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে গত ১১ এপ্রিল নিরাপত্তা প্রহরী পদে নিয়োগ পাওয়া এনামুল হক বলেন, ‘তারা ৩০ জুন ২০২২ এর পর আমার একাউন্টের চেকবহি জমা নেয়ার পাশাপাশি তিন মাসের জন্য একটি চেকে ৪৩ হাজার ১৩ টাকার স্বাক্ষর করিয়ে নেয়।চাকরিতে যোগদানের ৬ মাস চলছে অথচ বেতন পেয়েছি মাত্র দেড় মাসের (২১ হাজার টাকা)।’

মোহনপুর উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নিরাপত্তা প্রহরী হিসেবে কর্মরত মো. গাজিউর রহমান বলেন, ‘কর্মসংস্থান ব্যাংকের নওহাটা শাখায় কর্মরত খাজা মঈনুদ্দিন নামের এক ব্যাংক কর্মকতার সঙ্গে আমার বন্ধু পবার দারুশা কেন্দ্রীয় দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক মাহিনুর রহমানের পরিচয় ছিল।

এর সূত্র ধরে আউট সোর্সিং এ চাকরির নেয়ার জন্য আমি ওই ব্যাংক কর্মকর্তা ও তার সহযোগী শিরোইল কলোনী হাইস্কুলের লাইব্রেরিয়ান শিক্ষক লিটন আলীর মাধ্যমে বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসের লোকাল প্রতিনিধিকে গত এপ্রিল মাসে তিন কিস্তিতে নগরীর দড়িখরবোনা মোড়ে গিয়ে ১ লাখ ৬৫ হাজার টাকা দিই।আমি ২ মাস ২০ দিন পুঠিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে কর্মরত ছিলাম।

সেখানেও কোনো টাকা পাইনি।গত ১ জুলাই থেকে মোহনপুরে বদলির পর থেকে এখন পর্যন্ত  কোনো বেতন দেয়া হয়নি।বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে ব্যাংক কর্মকর্তা খাজা মঈন উদ্দিন বলেন, ‘আমি গাজিউর রহমানকে চিনি।ঘুষের টাকা লেনদেনের বিষয়ে জানতে চাইলে কোনো সদুত্তর না দিয়ে ‘ব্যস্ত আছি সাক্ষাতে কথা বললে ভালো হয়’ বলে এড়িয়ে যান।

একইভাবে অভিযোগ অস্বীকার করে শিরোইল কলোনী হাইস্কুলের লাইব্রেরিয়ান শিক্ষক লিটন আলী বলেন, এই বিষয়ে আমি কিছুই জানি না।বিষয়টি সম্পর্কে জানতে চাইলে পবার দারুশা কেন্দ্রীয় দাখিল মাদ্রাসার সহকারী শিক্ষক মাহিনুর রহমানের মুঠোফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তার ব্যবহৃত নম্বরটি বন্ধ পাওয়া যায়।

ঘুষ দিয়ে চাকরি নেয়ার কথা স্বীকার শিরোইল সাব সেন্টারের (স্বাস্থ্য) আয়া মমতাজ খাতুন বলেন, ‘আমি গত ৫ মে আয়া পদে যোগদান করি।যোগদানের আগে নাটোরের সিংড়া উপজেলার জুয়েল উদ্দিন নামের এক ব্যক্তির মাধ্যমে শাওনকে (জাকির হোসেন শাওন, বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড এ রাজশাহীর কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা) ৫০ হাজার টাকা দিয়েছি।

টাকা দিয়ে চাকরি নিয়ে পণ্ডশ্রম দিয়েই যাচ্ছি।এসব অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে জানতে চাইলে ‘বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড’ এর রাজশাহীর কার্যনির্বাহী কর্মকর্তা জাকির হোসেন শাওন বলেন, ‘আমি কোনো নিয়োগ বাণিজ্য করিনি।

আমি শুধু আমার ভাগ্নে-ভাতিজাসহ (নিকটাত্মীয়) ৬ জনকে চাকরি দেয়ার সুপারিশ করেছিলাম।যার জন্য আমার ভাগের যে ৪ লাখ টাকা ছেড়ে দিয়েছি। তবে মালিকপক্ষ নিয়োগ দেয়ার সময় জনপ্রতি ৪০-৫০ হাজার নেন।কী কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অনেক সময় কাজটি বের করে আনতে মন্ত্রণালয় বা অন্য কোথায় কিছু (টাকা) খরচ হয়।

এই টাকাটা তো মালিকপক্ষকে কোনো না কোনোভাবে তুলতে হবে।জানতে চাইলে ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠান ‘বিএসএস সিকিউরিটি সার্ভিসেস লিমিটেড’ এর ব্যবস্থাপনা পরিচালক (এমডি) আমিনুল ইসলাম সুলতানকে গত শুক্রবার (০৯ সেপ্টেম্বর) থেকে রবিবার (১১ সেপ্টেম্বর) সন্ধ্যা ৭টা ৫ মিনিট পর্যন্ত অসংখ্যবার তার মুঠোফোনে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলেও তিনি ফোন রিসিভ করেননি।

রাজশাহীর সিভিল সার্জন ডা. আবু সাঈদ মো. ফারুক বলেন, ‘২০২২-২০২৩ অর্থবছরের জন্য আউট সোর্সিং এর জনবল নিয়োগের মাধ্যমে সেবা কার্যক্রম চলমান রাখার জন্য ইতোমধ্যেই আমরা মন্ত্রণালয়ে আবেদন করেছি।যদি অনুমতি না দেয় তাহলে নতুন করে টেন্ডার করে নিতে হবে।

অর্থ লেনদেন কিংবা বেতন না দেয়ার বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে তিনি বলেন, ‘টাকা দিয়ে জনবল নিয়োগ কিংবা বেতন পায়নি এমন কোনো অভিযোগ আমার কাছে কেউ করেনি।অভিযোগ করলে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

তবে আউট সোর্সিং এর মাধ্যমে যারা নিয়োগ পেয়েছেন তাদের কার্যক্রম এখনো চলমান রয়েছে।যেহেতু এখনো এটির অনুমোদন হয়নি তাই ২০২২-২০২৩ অর্থবছরের বেতন-ভাতা বাকি রয়েছে।

IPCS News : Dhaka : আমজাদ হোসেন শিমুল : রাজশাহী।